Friday, October 29, 2010

"তুমি কি পড়?", "তুমি কি কর?" এবং আমার "সগর্ব বেকারত্ব"

সম্প্রতি যেখানেই যাচ্ছি বেশ এক বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। বিড়ম্বনার কারনঃ মানুষ দেখা হলেই প্রশ্ন করেঃ "তুমি কি পড়?"
প্রশ্নকর্তার মনের ভাব দেখেই প্রশ্নের উত্তর দেই। যদি দেখি সত্যি কথাটা বলা যায় তাহলে প্রশ্নের উত্তরে বলিঃ মাস্টার্স দিলাম - কিংবা এমবিএ শেষ করলাম।
কিন্তু তাতে দেখি আরেক বিপদ। সাথে সাথেই বলে উঠে "এখন কি কর?"
এবারও যদি দেখি সত্য বলা যায়, তাহলে বলিঃ "দু'বছর জব করেছি, এখন ছেড়ে দিয়েছি।"(বেকার ঠিক বলা হয়ে উঠেনা, কারন আমরা সবাই জানি ঐটা উহ্য রাখাই শ্রেয়, শ্রোতা ওটা ধরে নিয়ে থাকে)
এতেই জ্বালা। সাথে সাথে আরো একশ'টা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়ঃ
"মানুষ এই দুর্মূল্যের বাজারে একটা জব পায়না, আর তুমি জব ছেড়ে দিয়েছ?" "কোথায় জব করতে?" "কেন ছেড়ে দিলে?" "ওমা! ওখানে জব করতে - ওখানে শুনেছি ডলারে বেতন দেয়, আর তুমি ছেড়ে দিলে!!"

পড়েছি এক মহা জ্বালায়!



এদের কি করে বোঝাই, আমি এখন একটু অবসর নিচ্ছি, বাসাতে সময় দিব, মা'বাবাকে সময় দিব, বন্ধু বান্ধবের বাসায় বেড়াব, আত্নীয় স্বজনের খবরদারি করব, আর জীবনটাকে ঠিক উদযাপন নয়, "যাপন" করব???

বোঝানোর উপায় নেই, তাই একইধরনের বারংবার শুনতে থাকা প্রশ্নগুলা শুনে রাগ হয়, কখনো যে একটু আফসোস হয়না তা নয়- তাও হয়। তবে এই যে "কিছু না করা" মানে যে সব মানুষদের কাছে "অমর্যাদা"র বিষয় তাদের দেখে সবচেয়ে বেশি যেটা হয়, তা হচ্ছে "দুঃখ"।

এই সব মানুষের আসলে কি দোষ দেব?  সমাজ, সংসার, রীতিনীতি সবকিছু তাদেরকে শিখাচ্ছে, দেখাচ্ছে, শোনাচ্ছে যে "এটাই নিয়ম"।

এখন আমাদের পুরা জীবনটাই যে একটা বিশাল যান্ত্রিকতার ছকে বাধা হয়ে আছেঃ মায়ের পেটে থাকতেই মা'বাবা একটা সন্তানের জীবন কে যেন গেথে ফেলেন ছকে- মনে হয় সেই বাবুটা যতদিন ভ্রুন অবস্থায় মায়ের পেটে ছিল তত দিন ভাল ছিল। জন্মের পর থেকে শুরু হয়ে যায় তার ছকে চলা জীবন।

খুব ছোট বেলাতে তার চলে ছকে চলা খাওয়া দাওয়া। একটু হাটতে শিখতেই, কথা বলা শিখতেই সে স্কুলে যাবে- "প্লে স্কুল"। তারপর কেজি স্কুল, তারপর প্রাইমারি- হাই - স্কুলের বাইরে আবার কয়েকটা কোচিং-তারপর কলেজ-সবকিছুতে এ প্লাসের প্রেশার। এরপর পছন্দের সাবজেক্টে পড়ার জন্য চেষ্টা, তদবীর, অথবা মন খারাপ, আবার চেষ্টা, সফলতা এবং পড়া। পড়া শেষ তো জবের জন্য ছুটা - তারপর অবশেযে কোনো এক অফিসের খাচায় জীবনটাকে বন্দী করে ফেলা। এই ন'টা পাচটা আর তার বাইরে আরো দু'তিন ঘন্টা জ্যামে আটকা- করতে করতেই কর্পোরেট স্লেভ হয়ে জীবন অতিবাহিত করা। পাশাপাশি সংসার, সন্তান এই সেই। তারপর একদিন রিটায়ার্ড হওয়া। ভাগ্য ভাল থাকলে কোনো এক সন্তানের বাসায় অথবা তাও না থাকলে হাসপাতালের বেডে কিংবা ওল্ড হোমে জীবনের বাকি দিন গুনা- তারপর একদিন অবশেষে জেলখানা থেকে মুক্তি নিয়ে ওপারে পাড়ি জমানো।

ইহাই এখন জীবনের সংজ্ঞা! আফসোস! তবে এটা যে জীবনের "যাপন" নয় তাতে আমার আর কোনো সন্দেহ নেই।

এর বাইরে কি আমাদের কিছুই করার নেই? এই ছকের মধ্যে কি আমরা একটা সময়ও স্বেচ্ছায় "গ্যাপ" দিতে পারিনা - যে সময়টা শুধু একান্তই আমার নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য, নিজের আত্নীয় স্বজনদের জন্য, নিজের অনেকদিন ধরে না করা কাজগুলো করে ব্যয় করব??

প্রতিদিনের ব্যস্ততায় আমরা অনেক কিছুই তো করতে পারিনা। আমরা অনেকেই জানিনা কবে আমরা শেষবার একটা বই হাতে  নিয়েছিলাম পড়ার জন্য। কবে শেষবার মায়ের সেই বৃদ্ধা খালা কিংবা বাবার সেই বয়স্কা ফুফুকে দেখতে যেতে পেরেছিলাম। কবে আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কয়েকটা দিন শুধু ছেলেবেলার মত সেই বিলের মাঝে হেটে হেটে কিংবা নদীর ধারে বসে থেকে কাটিয়েছিলাম। কবে গ্রামে দাদুর বুড়িয়ে যাওয়া বান্ধবীটিকে দেখতে যেতে পেরেছিলাম। কবে?

এসব তো দূরের কথা - এমনকি এই যে আমাদের ঘরের জানালা দিয়ে যে সূর্যাস্ত কিংবা সূর্যোদয় দেখা যায়, আকাশ মাঝে অনেক তারার ঝিলিমিলি কিংবা পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যায় - তাও দেখার সুযোগ বলুনতো কবে হয়েছিল শেষবার??

জন্ম থেকে শেষ নিঃশ্বাস নেয়ার আগ পর্যন্ত-যেই গারদে আমরা নিজেদের বন্দী করে রেখেছি তা থেকে মুক্ত হয়ে কিছুদিন "কিছু না করতে" চেয়ে কি আমি খুব ভুল করে ফেলেছি?

এই কিছু না করার মধ্যে যে আনন্দ সেটা আমি কি করে তাদেরকে বোঝাই, যারা অনেক কিছু করে মানুষের চোখে অনেক বড় হতে পেরেছেন?যারা আমার মত স্বেচ্ছা-বেকারত্বের স্বাদ পাননি কখনো, তারা কখনো সেটা বুঝবেন না।

তাই আমি অবশেষে ব্লগের বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলাম মনের এই আকুতিঃ এই স্বাধীনতার মধ্যেই অবারিত সুখ, অবারিত আনন্দ।তাই বেকারত্বের মধ্যেই আমার গর্ব।

আর যাদের সাথে শেয়ার করতে পারছিনা এবং যারা "তুমি কি পড়?" "তুমি কি কর?" ছাড়া এর বাইরে কিছু ভাবতে পারেননা, তাদের জন্য নয়া এক ডিফেন্স সিস্টেম আবিষ্কার করলামঃ

প্রশ্ন একঃ "তুমি কি পড়?"
আমিঃ বোরকা/স্কার্ফ পড়ি।
তিনিঃ না, মানে...কিসে পড়?
আমিঃ (অবাক হওয়ার ভান করে) গায়ে/মাথায় পড়ি!
তিনিঃ (ওহহো!) আই মীন, কোথায় পড়??
আমিঃ কেন? বাইরে যেতে পড়ি! বাসায় কেন বোরকা পড়ব?!
এইবার তিনিঃ (মনে মনেঃ মাইয়া ইবা পাবনাত্তুন আইস্যেদে ফল্লাই, আর হতা হই লাভ নাই) ওহ, আচ্ছা!
এইবার আমিঃ (মনে মনেঃ যাক, এইবার আপদ বিদেয় হলো) (বাইরেঃ মুচকি হাসি)

প্রশ্ন দুইঃ "তুমি কি কর?"
তিনিঃ তুমি (এখন) কি কর/করছ?
আমিঃ আমি (এখন) আপনার সাথে কথা বলি/বলছি।
তিনিঃ মানে, কোথায় আছ?
আমিঃ জ্বী আপনার সামনে আছি।
তিনিঃ না, কোন কাজ করছ না?
আমিঃ কি বলেন? আপনার সাথে কথা বলা কি কোনো কাজ না?!
এইবার তিনিঃ (মনে মনেঃ মাইয়া ইবা পাবনাত্তুন আইস্যেদে ফল্লাই, আর হতা হই লাভ নাই) ওহ, আচ্ছা!
এইবার আমিঃ (মনে মনেঃ যাক, এইবার আপদ বিদেয় হলো) (বাইরেঃ মুচকি হাসি)

.........
আমাকে পাবনা ফেরত ভাবতে পারেন, নো প্রব্লেম। তবু দোহাই লাগে, প্লীজ, এবার আমাকে আমার মত থাকতে দিন! জীবন তো একটাই, এইটাকে একটু যাপন করতে দিন।

2 comments:

নিঝুম said...

প-ড়-লা-ম..

Anonymous said...

"প্লীজ, এবার আমাকে আমার মত থাকতে দিন! জীবন তো একটাই, এইটাকে একটু যাপন করতে দিন।"
এক্কেবারে মনের কথা বলসেন ভাই!
শুভকামনা।