কতোদি-ইন হয়ে গেল, চিঠি লিখা হয়না! সেই আবেগ মাখা ভাষার, নানান রঙ্গের, নানান ঢঙ্গের, নানান ভাষার চিঠি- কতইনা লিখেছি একসময়।
এখন বুঝি ভুলে যেতে বসেছি চিঠি লিখার ভাষা।
প্রথম চিঠি কবে লিখেছিলাম? মনে পড়ে চার বছর বয়সে মা-বাবার সাথে যখন পাড়ি জমিয়েছিলাম , সেই দূর অজানার দেশে, তখন থেকেই আমার চিঠি লিখার শুরু। "আলিফ বা" আর এবিসিডি তখন শেখা হয়ে গেলেও বাংলা মায়ের বর্ণমালার সাথে তখনও কেবল পরিচয় হবে, হচ্ছে। সখ্যতা হয় আরো পরে- বাবা যখন পার্মানেন্ট ইঙ্কে একটা ঝুলন্ত বোর্ডের গায়ে বর্ণমালা লিখে ঝুলিয়ে দিলেন চোখের সামনে- আর মা যখন দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া বাল্য শিক্ষা ধরিয়ে দিলেন হাতে-তারপর থেকে।
দেখতাম, কিছুদিন পরপর ঘটা করে চিঠি লিখার ধুম পড়ে যেত। বাসার মেইল বক্সে যেদিন দেশ থেকে দাদি, ফুপি, কিংবা চাচা-চাচিদের চিঠি জমা পড়ত, সেদিন হতো আমাদের ঈদের দিন। একটি খামে থাকত কমপক্ষে চার পাচেক চিঠি, বাড়ির সব্বাআর খবর একটু হলেও থাকত সেখানে।
তার পরদিন থেকে শুরু হতো উত্তর লিখার পালা। সবাই মিলে খাতা কলম নিয়ে বসে পড়তাম। ভাঙ্গা ভাঙ্গা অক্ষরে বাংলায় একটা বাক্য লিখতেই মা-কে শতবার বিরক্ত করতে হতো।
মনে আছে- মুরব্বি হোক আর সই ( তখনো আমার ছোট্ট কেউ ছিলনা, যাকে চিঠি লিখা যায়)-সবাইকে সম্বোধন করতাম "স্নেহের"- কারন, তালব্য শ'এ র'ফলা আর দ এর সাথে ধ যোগ করে "শ্রদ্ধেয়" লিখতে আমার বড্ড বেগ পেতে হতো!
সবচে' মজার অংশ ছিল, চিঠির পছনে মা আমাদের ভাই বোনদের হাত বসিয়ে হাতের চারপাশে বর্ডার একে দিতেন- কারন, ফুফুরা জানতে চায়- উনাদের আদরের ভাতিজি ভাতিজারা কত্ত বড় হয়েছে! হাতের ছাপ দেখে নাকি উনারা হাত ভেবে কাছে টেনে নিয়ে আদর করবেন!
কত্ত আবেগ মাখা ছিল সেই চিঠিগুলো!! এখন ভাবতেই মনে হয় রূপকথা!
আর সবচে' মজার ছিল আমার আর আমার প্রিয়তমা সইয়ের চিঠি গুলো। ও লিখত কোন ক্লাসে উঠেছে, কবে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো- কততম হয়েছে (নিশ্চয় প্রথম বা দ্বিতীয়) । তারপর লিখত "আর যদি পত্রের কোথাও ভূল হয়ে থাকে তো ভূল আর শুদ্ধটা লিখে দিবে" (তখনো আমরা জানের জান পরানের পরান দোস্ত হলেও অতি ভদ্রতার কারনে তুই তোকারি বলতে জানতাম না)। বলাই বাহুল্য - আমার ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় লেখা পত্রের ভুল আর ভুলের পাশে শুদ্ধ শব্দের বেশ লম্বা লিস্টি ওর পত্রের নিচে ছকাকারে দেয়া আছে।
আমার অল্প স্বল্প বাংলা জ্ঞান দিয়ে তখনো ওর মতো এমন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টের ভুল ধরার মতো দুঃসাহস হয়ে উঠেনি, তাই স্বরণাপন্ন হলাম গুরুজী আম্মাজানের। আম্মু বললেন, ওর পত্রে নাকি কেবল একটাই ভুল, আর সেই ভুল হচ্ছে স্বয়ং "ভূল" শব্দটিই!!
খুব সম্ভবতঃ তারপর থেকে, অবধারিতভাবেই ওর পত্রের নিচে থাকত-"ভুল হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে"- এই ভুলে কি হ্রস্ব উকার, নাকি দীর্ঘ ঊকার থাকতা এখন আর মনে পড়ে না।
সইয়ের সাথে আবেগ মাখা ভাষায় চিঠি লিখার পর্ব তখনো শুরু হয়নি- এখনকার পিচ্চিদের মতো আমরা অত কিছু জানতাম না তো! এই পর্বটা শুরু হলো আরো পরে, যখন আমরা দেশে চলে এলাম, আর তার পরপরি সই ওর পরিবারের সাথে আরেক অজানার দেশে পাড়ি জমাল।
আমাদের নিয়তিটাই এমন, খুব বেশিদিন আমাদের একি দেশে, একি শহরে থাকা হয়নি কখনো- আর কখনো হবেওনা হয়তো! তাই চিঠিই ছিল বন্ধুত্বের ভেলাটাকে ভাসিয়ে রাখার একমাত্র ভরসা।
ও যাওয়ার আগে আমরা এক গোপন কোড ভাষা রপ্ত করে নিলাম, আমাদের দুই সখির চিঠির যদি আর কোনো পাঠক হয় তো (হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ছিল তখন) আমাদের গোপন কথা গুলি যেন অন্তরালে থেকে যায়, তাই!
তারপর একদিন বিশেষ ভাবে আমার নামে চিঠি আসল! আমার যে কি আনন্দ! ওর কি অবস্থা, বিদেশে ওর কেমন লাগছে, পড়াশোনার কি অবস্থা সব জানিয়ে শেষে কোড ভাষায়ও দু-এক বাক্য লিখতে ভুললনা।
এখনো সযত্নে রাখা আছে সেই বিখ্যাত চিঠি!
তারপর থেকে আমাদের চিঠি আদান প্রদান শুরু হলো পুরোদমে- যার পৃষ্ঠা সংখ্যা, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ্য- কোনো কিছুরি ইয়ত্তা নেই। হেন কোনো বিষয় ছিলনা, যা বাদ পরত! বড় আপুরা আমাদের চিঠির সাইজ দেখে ক্ষেপাতেন- "এটা কি রচনা, নাকি থিসিস?!"
৩/৪ বছর কেটে গেল এভাবে- কারো বার্থডেতেই কেউ কার্ড পাঠাতে ভুল করতাম না- তাও সে কী রোমান্টিক কবিতা দিয়ে ঠাসা!
মাঝে মাঝে এখানকার পোস্ট অফিসে আমার চিঠিগুলো খোয়া যেত! ও একবার দেশে এসে জানাল, আমাকে নাকি ২২ পৃষ্ঠার একটা চিঠি লিখেছিল- আর আমি তা পাইনি!!!
তারপর একদিন, ২০০২ সালে, বাসায় চলে এলো নেট কানেকশন। ইমেইল আর মেসেঞ্জারও এল অবধারিতভাবে।
দিনে যে কয়বার, কয় ঘন্টা ধরে চ্যাট করতাম, তার কি আর হিসেব আছে?! তারপরও মেইল করা হত প্রায়শঃই! সেই সুইট সিক্সটিনে সইয়ের সাথে কত কথারই না ফুলঝুরি উড়াতাম কীবোর্ডে দুহাত রেখে!
আস্তে আস্তে মেসেঞ্জারের কারণে ইমেইলর সংখ্যাও কমে গেল। তেমন একটা আর মেইল করা হয়ে উঠত না। বার্থডে গুলোতেও কেবল একটা ঈ-কার্ড- যার মেয়াদ ৩০ দিনের বেশি না!
তার উপর প্রযুক্তি যখন আরো দয়া পরবশ হয়ে হাতে মুঠোফোন ধরিয়ে দিল, তখন তো প্রতিটা দিন অন্ততঃ কয়েকবার এসএমএস করতে করতে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম চিঠি নামক মান্ধাতার আমলের ধীরগতির যোগাযোগ মাধ্যমটাকে।
আর তারপর, কর্ণফূলীর গা বেয়ে অনেক পানি বয়ে গেছে...।
সেই প্রিয়তমা সই, তার প্রিয়তম এর হাত ধরে এক অজানার দেশ থেকে আরেক অজানার দেশে পাড়ি জমিয়েছে। সংসারের ব্যস্ততায় আগের মত এসএমএস করা হয়না, ইমেইল তো দূরে থাক। ৬ ঘন্টার ব্যবধানে মেসেঞ্জারেও দেখা হয় কদাচিত। তবে খবরাখবর রাখা হয়, কখন কোন দেশে কি করছে, তা জানা যায়। যেমন জানা আছে, সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সে আরেক অজানার দেশে উড়াল দেবে।
আমি পড়ে রইলাম আগের ঠিকানায়। মাতৃভূমির শিকড় আকড়ে ধরে আছি বলেই হয়তো- বারবার মনে পড়ে যায় সেই ছোট্টবেলার কথা- সেই আবেগঘন ভাষার চিঠিগুলোর কথা, হাজারটা ইমেইল এসে ইনবক্স ভর্তি হয়ে এলেও সেই আবেদন কি আর আছে এতে?
কোথায় জানি পড়েছিলাম, মানবদেহে স্নায়ু আর হরমোনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ইমেইল আর চিঠির মতো। স্নায়ুর মাধ্যমে বার্তা যেমন খুব দ্রুতগতিতে পৌছে যায়, কিন্তু এর প্রয়োগ হয় ক্ষণস্থায়ী,ইমেইলের মাধ্যেমে পাঠানো বার্তা খুব দ্রুতগতিতে পৌছে গেলেও কিন্তু এর আবেদন ঠিকই ক্ষণস্থায়ী। আর হরমোন যেমন কাজ করে খুব ধীরগতিতে, কিন্তু এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি, চিঠির ব্যাপারটিও তাই।
আজ অনেকদিন পর সেই আবেগঘন চিঠির কথা মনে পড়ে- একটি চিঠি লিখে উত্তরের জন্য সেই প্রতীক্ষার কথা মনে পড়ে- আর মনে পড়ে হাতে চিঠি পেয়ে সেই কী যে আনন্দে দুলে উঠত আমার কিশোরী মন!
এখন-প্রতিদিনই চ্যাট হয়, খোজ খবর রাখা হয়, ভাল মন্দ আলাপ হয় ঠিক, কিন্তু আগের সেই প্রতীক্ষা, সেই আনন্দ, সেই আবেগ- সব বুঝি হাওয়ায় উবে গেল!
প্রশ্ন জাগে, প্রযুক্তি কি দুপ্রান্তের দুই বন্ধুকে কাছে এনেছে, নাকি বরং সেই আজন্মকাল থেকে চলে আসা হৃদয়ের বন্ধনটাকে ছিন্নই করে ফেলেছে?
মা হওয়া ৭: টিভি দেখা, না দেখা
-
আমাদের বাসায় টিভি না রাখা (কিংবা না ছাড়া) এবং
টিভি/ইউটিউব/আইপ্যাড/স্মার্টফোন এসব আমাদের মেয়েটার দৈনন্দিন জীবনের অংশ না
করার সিদ্ধান্ত প্রাথমিক ভাবে কোনো ই...
9 years ago
11 comments:
দারুন ।
শেষ লাইনটায় প্রজুক্তি আসলে কি করেছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করছি । ব্যাপারটা এরকম .. আগে অনেকদিন অপেক্ষা করে একটা চিঠি পাওয়া যেত । অপেক্ষার যন্ত্রনাটাই ছিলো একটা সুখের ব্যাপার । অনেক অপেক্ষার পর কাঙ্খিত কিছু পাওয়া, অন্যরকম কিছু......!!!
এখন প্রযুক্তির কল্যানে যোগাযোগের ঘনত্ব (!!) বেড়ে গিয়েছে নিশ্চয় ই । তাই অপেক্ষার ব্যাপারটা না থাকায় আবেগের ব্যাপারটাও বোঝা যাচ্ছে না ।
আমার মনে হয় সবই ঠিক আছে ।
ashole thik bujhte parchina -
valo-mondo duitai ache projuktir..
tobe amar mote majhe moddhe ektu nostalgic hoye jawaro dorkar ache.
আপনার লিখাটা পড়ে ভালো লাগলো। আমি জীবনো চিঠি খুব কম্ লিখছি। সব মিলিয়ে দশটা হবে না। এজন্য ভালো চিঠি ও লিখতে জানতাম না। :(
চিঠির যুগ মনে হয় উঠেই গেল। আর দু'এক প্রজন্ম পর তো "মানুষ চিঠি লিখতো" এটা শুনলেই লোকজন বিশ্ময়! প্রকাশ করবে। চিঠির পাশাপাশি আরও একটা জিনিস উঠেগেছে। আমি যখন বাইরে ছিলাম তখন দেখছিলাম, অনেকে বিদেশে চিঠি না পাঠিয়ে অডিও ক্যাসেট রেকর্ডিং করে পাঠাতো। এই জিনিসের সাথে কয়জন পরিচিত আছেন কে জানে? আমি যখন এ ধরণের অডিও রেকর্ডিং চিঠি শুনতাম আমার প্রচন্ড হাসি পেত। ইদানিং সেই ক্যাসেট রেকর্ডিং-এর জায়গা দখল করে নিছে Voice Message. :D
হুম... আমার সেই আঠারো পৃষ্ঠার চিঠির দিনগুলো কই গেলো!!! শেষ কথাটা সত্য। Virtually, we speak so much but mean so little of that! বলতে যত কষ্ট হয়, তত বেশি ভেবে বলা হয়। অনেক সময় মনে হয়, ভার্চুয়ালি কথাগুলো যেন বলার জন্যই বলা হচ্ছে। তখন আর লিখতে ইচ্ছা করে না, ইমেইলের জবাব দিতে ইচ্ছা করে না।
প্রযুক্তি আমাদের মানুষগুলোকে কাছে আনছে ঠিকই, কিন্তু, মানুষ আমরাই যে এখন যান্ত্রিক কিছু হৃদয়হীন অমানুষ হয়ে গেছি...।
তরংগ, ঠিক বলেছেন, আমার আগে স্ট্যাম্প কালেকশনের সখ ছিল, প্রায় হাজার খানেক স্ট্যাম্প এখনো আছে সংগ্রহে। ভাবছি এগুলো আর ঐ চিঠিগুলো রেখে যাব, ভবিষ্যতে আমার গ্রেট গ্রেন্ড চিল্ড্রেন রা এগুলো নিলামে তুলে হয়তো সারাজনমের জন্য কামিয়ে নিতে পারবে! (দেখেন আবার, বুদ্ধিটা আপনিও খাটাতে যাবেননা, তখন আবার আমার সব আশা গুড়ে বালি হয়ে যাবে)
ক্যাসেট পাঠানোর কথা আমিও শুনেছি, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়নি। একবার আমার গ্রামের এক মেয়ের মুখে শুনেছিলামঃ
"বিদেশততুন স্যাকেট ফাটাইয়েদে..."
(হাহাহাহা... অনে নিশ্চয় বুইজ্জন :))
সন্ধ্যা, তুইও কি আঠার পৃষ্ঠার চিঠি লিখতি নাকি?
মজার কথা হচ্ছে আমাদের আপুরাও লিখত, আর পরে ঐ একই ধারা আমরা ফলো করছি দেখে মুচকি মুচকি হাসত।
আর আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা আর নাই বা বললাম...।
@ অচেনা পথিক
ন ক্যানে বুইজ্জুম। আঁরার ভাষা যদি আঁরা নবুঝি তইলি ক্যানে অইবু?
হা হা হা ... :D
আপনি কি চট্টগামের ভাষা ভালো বলতে পারেন?
মাতৃভাষা বলতে না পারলে আর কোন ভাষা বলতে পারব?
আমারো চিটাইংগা ভাষায় কথা বলতে ইচ্ছা করছে! আম্মাম্মাম্মাম্মা ;( (এটা হল গলা ছেড়ে কান্না! কারন আমি চিটাইংগা ভাষায় কথা বলতে গেলে সবাই হাসে ;( )
hihihi kandte thaken.. sorry, ki ar korben?
রচনা নাকি থিসিস মনে করে আগে পড়ি নাই!!!!
যখন মোবাইল আসে নি....
প্রচুর চিঠি পেতাম, দিতাম কম। বেশিরভাগই ছিল আব্বার পাঠানো। আম্মা, দাদারও পেতাম। ছোট ভাইয়েরও পেতাম বেশ। সেই সব চিঠি লেখার দিনগুলি এখন ইতিহাস। মোবাইল জায়গাটা দখল করে ফেলেছে। মোবাইল কাজটা ঠিক করেনি!
Mahmud vai, dhonnobad montobber jonno.
Post a Comment