এনির সাথে দেখা হয়েছিল পরেরদিন অফিসে গিয়ে। খুব সুন্দর একটা টোল পড়া হাসি দিয়ে ধবধবে সাদা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বরণ করে নিল চাইনিজ চেহারার মেয়েটি। জানতে পারলাম ওর জন্ম তাইওয়ানে হলেও ছোট বেলায় এমেরিকায় মাইগ্রেট করে এখন ও পুরোদস্তুর এমেরিকান। আপাততঃ মাসখানেকের জন্য বোস্টন অফিস থেকে ওকে পাঠানো হয়েছে চিটাগং অফিসটা সেটল করা পর্যন্ত থাকার জন্য।
তখনকার ছোট্ট অফিসটায় জুনিয়র সিনিয়র বস সাবর্ডিনেট সবাই মিলে একটা টেবিলের চারপাশে বসে যার যার ল্যাপটপে কাজ করার এক অদ্ভুত সিস্টেমে গিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলাম।প্রতিদিনই মিটিং হতো গত কর্ম দিবসের নানা আপডেট নিয়ে, আর আমার কাজটা ছিল মিটংএ বসে মিনিট টাইপ করা। এনি ছিল তখনো আমার অলিখিত সুপারভাইজার। ওর কাছ থেকেই নানান ধরনের কাজের এসাইনমেন্ট পেতাম আর কাজ শেষে রিপোর্টও করতাম ওকেই।
বস বস শুনালেও ২৫/২৬ বছরের এই প্রচন্ড কাজপাগল মেয়েটি (মহিলা বললে ভুল হবে) কখনোই বস মনে হয়নি। সদা হাস্যোজ্জল এনির স্বভাবই ছিল গম্ভীর মুহুর্ত গুলো তে ওর বিখ্যাত অট্টহাসি কিংবা একটা রসাত্মক কমেন্ট ঢুকিয়ে দিয়ে হাল্কা করে তোলা।
কাজের কারনে ওর সাথে দীর্ঘ সময় কাটাতে হতো বলেই, কিংবা বয়সের ব্যবধানের স্বল্পতার কারনে হয়তোবা, ঘনিষ্টতা আমাদের দিন দিন বাড়তে লাগল। আমাকে নিয়ে ওর ছিল যত্ত কৌতুহল, বিশেষ করে আমার ঐ হিজাব নিয়ে।"এটা কি অবশ্যই পরতে হয়?, হিজাবের উদ্দেশ্য কি?, বোরকা কি কালই হতে হবে-অন্য কোন রঙ্গের হলে সমস্যা হবে, হাত কেন ঢাকতে হবে, হাতের মধ্যে এমন আকর্ষনের কি আছে?, বিয়ের জন্য কনে দেখতে গেলে কনে কি হিজাব পরবে"......ইত্যাদি হেন কোন প্রশ্ন ছিল না যা ও করত না। এছাড়া ওর আরেক আগ্রহের বিষয় বস্তু ছিল বাংলাদেশের বিয়ে। এরেঞ্জড মেরেজ নিয়ে ওর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মনে হল এই বিষয়ে আমার পি এইচ ডি টা এই ফাকে হয়ে গেল।
প্রচন্ড কৌতূহল ছাড়া ওর আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল মানুষকে ভালবাসা। পুরো অর্গানাইজেশনের সবচে জনপ্রিয় কে এই প্রশ্নের উত্তরে সবাই এক বাক্যে নির্দ্বিধায় বলে দিবে এনির নাম। এ প্রসঙগে পরে আসছি...
আর ওর হাস্যকর সব কান্ড কারখানার নমুনা না দিলে ওর সম্পর্কে এই লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। একদিন ওকে আরেক কলিগ আমন্ত্রন জানাল ঊনার গ্রামে বৃক্ষরোপন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার। এনি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল! ওকে ভয় লাগিয়ে দিতে বললাম আমাদের দেশে অতিথি হিসেবে কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলে অবশ্যই বক্ত্বতা দিতে হয়। সত্যি ভেবে শেষে ও রাজি হল। আর যেহেতু গ্রামের অনুষ্ঠান, তাই বললাম, ওকে বাংলায় বক্তৃতা দিতে হবে- এতেও দেখি ও রাজি হয়ে গেল!
শেষে আমাদের কয়েকজনের সাহায্যে সে ঠিকই বাংলায় একপ্রৃষ্ঠা বক্তব্য লিখে মুখস্থ করে নিল। "আমাড় প্রিয় ভাই এইবং বোওনেড়া" এর পর ওর মুখ থেকে প্রায়ই শোনা যেত।
হাস্যকর কান্ড কারখানার সবচ্যে মজার অংশে আসি এইবার। একদিন ওর সখ জাগল, বোরকা পরবে! আমাকে বলল ওর জন্য বোরকা নিয়ে যেতে। আমি জানতাম এইটা ও কৌতুক করে বলছে না, সত্যিই সে পরবে।
পরের অফিস ডেতে সত্যি নিয়ে গেলাম! এর কিছুদিন পরই আমাদের একটা সেমিনার ছিল। সেদিন আমাদের যেতে বলা হল সেমিনারস্থল, অর্থাত চট্টগ্রামের সবচেয়ে নামকরা হোটেলের একটা কনফারেন্স হল গিয়ে দেখে আসার জন্য। আর এনির সখ চাপল, ঐখানে যাওয়ার সময়ই সে বোরকা পরবে!
বোরকা পরে যখন ও নামল, কেউ কেউ ভাবল আমার বোন, কেউ ভাবল কোন ভিসিটর! আর যখন ওর মুখ থেকে কথা বেরুল, তখন সবার সেই কি যে বিস্ময় আর হাসি! কেউ হাসছে, কেউ অবাক হচ্ছে, আর রিসিপশন এরিয়ার চারপাশের সবাই জটলা পাকিয়ে দেখতে লাগল ওকে। এক মুসলিম কলিগ বলেই উঠল, "আমরা মুসলিম হয়েও কখনো সখ করেও বোরকা পরিনা, আর ও!"
আরো মজার কান্ড হল যখন আমরা গন্তব্যস্থলে পৌছালাম। এনির বাচ্চা মার্কা কান্ড কারখানা, আমার পাশে বসে আমার সব আচরন নকল করা, আর ঐ বোরকার অন্তরালে চুপচাপ বসে থাকায়, হোটেলের কেউই বুঝতে পারেনি ওর ভূমিকা আসলে কি। শেষে যখন ওর ভীষন ডিটেইল অরিয়েন্টেড প্রশ্নের পালা শুরু হল, বুঝা গেল ওরা ভীষন চমকে উঠেছে।
এইতো সেদিন বন্ধু দিবস গেল, ও শিখে নিল বাংলায় কিভাবে শুভেচ্ছা জানাতে হবে। আমাকে আগ বাড়িয়েই বলল, দাড়াও আমি বাংলায় বলি- " শুভোও বুনঢো ডিবওশ"!
একদিন ওকে দাওয়াত দিলাম আমার বাসায়। আম্মুর রান্নার ভীষন ভক্ত বনে গেল ও! আর বাসার সবার মাথায় ওরনা জড়ানো দেখে ও মাথায় ওরনাটা জড়িয়ে নিল। যতোক্ষন ছিল, ওরনাটা মাথায়ই ছিল।
লেখাটা যখন শুরু করেছিলাম, তখনো এনি দেশে ছিল- চলে যাবে কিছুদিনের মধ্যে জানতাম- তবে ওর ফ্লাইট তখনো কনফার্ম হয়নি। গত বৃহস্পতিবার ও চলে গেল। যাওয়ার আগে দেখলাম ওর জন্য ছাত্রীদের কি ভীষন দরদ (ও বা আমরা কেউই ছাত্রীদের পড়াইনা)। ওকে সবাই এত্ত ভালবাসে না দেখলে বুঝার উপায় নেই।সব্বার এত্ত এত্ত গিফট পেয়েছে ও, কোনটা কে দিয়েছে সেটাই মনে করতে পারছেনা! যাওয়ার দিন দেখলাম সবাই একটু বিদায় বলার জন্য, একটা ছবি তোলার জন্য কিভাবে রীতিমত লাইন ধরেছে! একজন ছাত্রী এল, একটা মাথার ক্লিপ দেয়ার জন্য। এনি বলল, "তুমি আমাকে এত্ত কিছু দিয়েছ, আবার কি দিতে চাও?" মেয়েটি বলল- "এটা নতুন কিছু না, এইটা আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস"
এমন ভাবে সবার ভালবাসা আদায় করে নিতে পারার অসম্ভব সুন্দর গুনটি, আফসোস, আজকে কেবল "ওদেরই" একচেটিয়া দখলে চলে গেছে। আমরা যে এখনও ব্যস্ত, এ ওর দোষ খুজতে, পিছন থেকে সমালোচনা করতে আর নিজের নাক কেটে হলেও পরের যাত্রা ভাংতে......
সুপার পাওয়ার হওয়া কি এ জন্যই কেবল "তাদের" পক্ষেই সম্ভব?
12 comments:
চমৎকার লেগেছে।
.......সুপার পাওয়ার হওয়া কি এ জন্যই কেবল "তাদের" পক্ষেই সম্ভব?
সম্ভবত এটা এ কারণেও হতে পারে ওদের কনফিডেন্স লেভেলটা অন্যদের তুলনায় বেশি। সহজে নিজেদের বড় ভাবতে পারে। আমরা নিজেদেরকে খুব বেশি উন্নত মনে করতে পারি না ফলে আমাদের আচরণগুলোও বোধহয় সেকেলেই রয়ে যাচ্ছে!
নিজেকে উন্নত ভাবার কৌশলটা কি? ইয়াসির ফাজাগার এক লেকচারে শুনেছিলাম জ্ঞান নাকি মানুষকে মুক্ত করে।
একটানে পড়লাম পুরোটা... ভাল্লাগ্লো। আপনি আসলেই খুব ভালো লেখেন...
@মাহমুদ ভাই, ওদের আত্নবিশ্বাসের পাশাপাশি সহমর্মীতাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা হয়তো খুব বেশী আত্নবিশ্বাসী হতে পারিনা বলে যার তার সাথে, যেকোনও 'লেভেল' এর মানুষের সাথে সহজে মিশে যেতে কষ্ট হয়। ঐ যে বলে না, উত্তম নির্বিঘ্নে চলে...।
জ্ঞান এর ব্যাপারটাও হয়তো ঠিক। এনির যাওয়ার মাত্র কিছুদিন আগে আমি জেনেছি ও Yale থেকে গ্র্যাড আর Harvard থেকে পোস্ট গ্র্যাড করেছে! কথাবার্তায় কখনও তা মনে হয়নি আমার কাছে!
@বিস (বিষধর সর্প)- এটা কি কোনও নতুন প্রকারের ছোবল? কবে থেকে বিষ ছেড়ে তৈল উত্পাদনে মনোনিবেশ করলেন?
একটানে পড়লাম। এনি চলে গেছে ক্যান? ;( তোমার লেখা পড়েই আমার ওকে ভাল লেগে গেছে। ইশ, দেশে থাকলে তো দেখা করা যেতো। ওর সাথে তোমার নিশ্চয়ই যোগাযোগ আছে। ওকে আমার ভালবাসা বলিও।
এনির ছবিটা দেখে এখানের ইন্দোনেশিয়ান মেয়েগুলোর কথা মনে পড়ছে আমার। এশিয়ান মেয়েগুলোর মধ্যে অহংকার থাকেনা, এরা তাই সহজেই অন্যদের বন্ধু করে নিতে পারে। বাঙ্গালী হিসেবে আমাদের মধ্যে এই গুণটাকে খুঁজে পাওয়া যায়না সহজে। প্রত্যেক সংস্কৃতি থেকেই আমরা ভাল দিকগুলোকে খুঁজে নিতে পারি, তাতে আমাদের ভাল ছাড়া খারাপ হবার কোনও সম্ভাবনা নেই।
@যাযাবর, এনি চলে গেছে অর্গানাইজেশনের নির্দেশে। ওর সাথে আমার আর তেমন যোগাযোগ হয়নি। এতোদিনে ওর ইনবক্সে নিশ্চয় হাজারটা মেইল জমা আছে, তাই আমার মেইলের জবাব পাইনি এখনও।
@টক্স, ঠিকই ধরেছেন, এনিও ঐদিন নিজেকে মালয়েশিয়ান বলে বেড়াচ্ছিল।
এনির অনেক গুনই এখানকার অন্যান্য আমেরিকানদের মধ্যে দুর্লভ। খুব সম্ভব এশিয়ান হওয়ার কারনেই অন্যদের সাথে মিশার ক্ষমতা ওর অসাধারন।
আর হ্যা,একমত-সবার ভাল দিকটা গ্রহন করলেই কেবল জাতি হিসেবে আমরা উন্নত হতে পারব।
খুবই ভালো লাগল। চমৎকার লেখনী। এনির বন্ধু হয়ে গেলাম যেন।
খুব ভাল লাগল এনিকে।
ধন্যবাদ এনির কথা শেয়ার করার জন্য।
ধন্যবাদ, ভোরের কোলাহল এবং পাশা ভাই-পড়ার এবং মন্তব্য রেখে যাওয়ার জন্য।
পড়লাম.. এবং ভাল লাগলো... অচেনা পথিক'কে অনেক ধন্যবাদ।
আজ অনেকদিন পর এনির রিপ্লাই পেলাম।
প্রথম এবং শেষের লাইন পড়ে এইখানে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছিনা।
মেইলটা শুরু হল এভাবে:
Assalamu Alaikum Ojana*
Kemon Achen? Ami valo achi.....
আর শেষ হলো এভাবে
Love
Annie
P.S. Amar ekhon jete hobe, kathal khawar jonno**
*এখানে অবশ্য আমার নাম দিয়েছে
** ওর বাংলা বক্তব্য তৈরি করে দেয়ার সময় ও বলছিল, হাস্যকর কিছু দিয়ে ও শেষ করতে চায়। শেষে ভেবে বের করল এই কথাটি। মনে হচ্ছে লাইনটা কপি পেস্ট করে দিয়েছে ঐ বক্তব্যের ডকুমেন্ট থেকে :)।
বোঝা গেল বাংলা আর বাংলাদেশ কে এখনও ভোলেনি এনি..।
আর হ্যা, ত্রিভুজ ভাইকে অনেক ধন্যবাদ সময় করে পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্য।
খুব ভাল লেগেছে লেখাটি।
Post a Comment