Friday, September 5, 2008

আল জাযিরার সাথে আধা দিন ...(৩)

পরের দৃশ্য ছিল সখিনার বাবার ইন্টারভিউ।উনি বলছেন আর আমি অনুবাদ টা লিখে নিচ্ছিলাম। গ্রামের একজন সহজ সরল অল্পশিক্ষিত বাবা হয়েও শিক্ষার গুরুত্ব উনি ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছেন, আর তাই উনার মেয়েকে শিক্ষিত করতে উনার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করতে উনি কখনও পিছপা হননি। আজ তিনি মনে করেন উনার মেয়েকে এমন পর্যায়ে পৌছে দিয়েছেন, মেয়ে বিয়ে দিতে আর উনাকে যৌতুকের সরনাপন্ন হতে হবে না। এতটুকু বলতেই ইন্টারভিউর সমাপ্তি ঘোষনা করা হলেও উনি জানালেন এখনো উনার সবটুকু বলা হয়নি। উনি আরো বলতে চান। এর বেশি সময় দেবার মত সময় ওদের হাতে নেই বলতেই বুঝা গেল একটু মনঃক্ষুন্ন হয়েছেন উনি। আমাকে জানালেন উনি শেষ করতে চান "আমার মতে দেশের সব নাগরিকের উচিত নিজের সন্তানদের সুশিক্ষিত করে তুলতে কোনো প্রকার অবহেলা না করা" এই কথাটা দিয়ে। অগত্যা অনুবাদে কথাটা যুক্ত করে দিলাম।



এর পর নেয়া হল সখিনার ইন্টারভিউ। বিশাল এক বোম্ব মাইক বের করে নিচে থেকে ধরে থাকলেন এলেক্স। আর সখিনা ওর বাড়ির সামনে দাড়িয়ে সংক্ষেপে বলতে লাগল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারন, গ্রামে বেড়ে উঠা মেয়ে হিসেবে নানা দেশের মানুষের সাথে মিশতে গিয়ে প্রথম দিকে পড়া সমস্যা ও তা সমাধান করার কথা। শেষে দেশের জন্য ও কি করতে চায় ভবিষ্যতে তা জানিয়ে শেষ করল ওর সংক্ষিপ্ত ইন্টারভিউ।


আনষ্ঠানিকতা মোটামুটি শেষ হলেও বাকি রয়ে গেছে আরো কিছু কাজ। এইবার আহমাদ বের হয়ে গেলেন ভিডিও ক্যামেরা আর এলেক্স, ওর স্টিল ক্যামেরা নিয়ে। অঘোষিত বিরতি চলল কিছুক্ষন, যদিও বিরতিহীন ভাবে নানান কিসিমের গ্রামীণ দৃশ্য তুলতে লাগল ওদের ক্যামেরা। মজার কান্ডটা তখন করছিলেন সো। আপন মনে বিড়বড় করে স্ক্রিপ্টটা মুখস্ত করছিলেন উঠোনে হেটে হেটে। এই দৃশ্য দেখে সখিনা আর ওর কাজিনদের দল হাসতে হাসতে লুটোপুটি অবস্থা। এরপর গ্রামের সবচেয়ে সাধারন দৃশ্য গুলো অসাধারন হয়ে ধরা পড়তে লাগল উনার ক্যামেরায়-দূরে দাড়িয়ে থেকেও বুঝতে পারলাম এর মধ্যে ছুটোছুটি করতে থাকা মুরগিটা ছিল প্রধান আকর্ষন।

যাওয়ার বেলায় আরো কিছু ছবি তুলতে লাগলেন উনারা। সো তখন সখিনার বৃদ্ধ দাদার সাথে ছবি তুললেন বেশ আগ্রহ ভরে। হাতে সখিনার মায়ের দেয়া চন্দনাইশের বিখ্যাত পেয়ারা। চুপিসারে লক্ষ করলাম সবার অগোচরে সখিনার দাদার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলেন। সখিনার বাবা উনাকে উর্দু ভাষায় বলে ফেললেন "আমার বাবা পাকিস্তানের খুব ভক্ত, আমরা তো আগে এক দেশ ছিলাম - উনি সে আমলের কথা ভুলেননি"।

সবাইকে সালাম আর "আপকো বহুত শুকরিয়া" জানিয়ে বিদায় নিল বাড়ি থেকে, হাতে কিংবা ব্যাগে তাদের "পেয়ারা" উপহার-একটি করে পেয়ারা সমেত। অল্প কিছুদূর যে পথ হেটে যেতে হবে তার দুই পাশে তখন দর্শকদের সারি। হঠাত দেখি কিসের যেন ছবি তুলতে এলেক্স অন্য পথে পা বাড়াল। পিছু নিল ছেলেপুলেদের দল। আমিও গেলাম। দেখি একটা বিশাল পুকুর। পরে আহমাদ এই পুকুরের কথাই এলেক্সকে বলছিল, "দিদ ইউ তেইক পিকতারয অফ দা স্মল লেইক? ওয়েন আই ওয়েন্ত যেয়ার, এন অল্দ ম্যান ওয়ায তেইকিন বাথ"।

টিভিতে যখন নিউজ দেখেন, নিশ্চয় দেখেছেন রিপোর্টার শেষে কিছু কথা বলে ক্যামেরার সামনে দাড়িয়ে। কখনও বা স্থির দাড়িয়ে থাকে, কিংবা হাটতে থাকে। কখনও শেষ করে দেয় এই দৃশ্য দিয়েই, কখনও পরে আরো কিছু কথা বলে।

এইবার দেখলাম এই দৃশ্যের ই মেকিং। একটা ছোট পথ বেছে নিলেন উনারা। সো হেটে হেটে এই পথ দিয়ে আসবেন আর রিপোর্টটা এভাবেই শেষ করবেন।

খুব সহজ মনে হলেও ব্যাপারটা আসলে যে কত কঠিন নিজ চোখে না দেখলে বুঝতাম না! ক্যামেরা ম্যানের পিছনে তখন দেখি তানভির সাহেব, অনেকটা জড়িয়ে ধরার ভঙ্গিতে।

তারপর পিছন দিকে হেটে আসতে ক্যামেরাম্যান কে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসতে লাগলেন, আর এদিকে সো উনার মুখস্ত করা স্ক্রিপ্ট বলতে বলতে সামনে আসতে লাগলেন। একবার উনার স্ক্রিপ্ট ভুলে গেলন, আরেকবার পাশে দাড়িয়ে থাকা কৌতূহলি জনতার মোবাইল বেজে উঠল, আর একবার সব ঠিক ঠাক হলেও আরও একবার নাকি "সেফটি" হিসেবে একটা টেক নিয়ে রাখতে হয়- তাই বেশ সময় নিয়ে চলতে লাগল এই দৃশ্যায়ন।
ওদিকে তখন একটু দূরে দাড়িয়ে এলেক্স তুলতে লাগল একের পর এক ছবি-গ্রামীন বধু, গ্রামীন নারী, আর গ্রামীন পোলাপান দের। ঠিক এমনি নাকি একটি গ্রাম ও দেখেছিল দশ বছর আগে, দক্ষিন আফ্রিকার কোনো এক দেশে (নামটা আগে কখন ও শুনিনি, এখন আর আমার মনে নেই)

"সো রাহমান- আল জাযিরা, চিটাগং" বলে সো যখন শেষ করলেন রিপোর্ট, আনুষ্ঠানিক কাজ তখন শেষ। এরপর রইল অনানুষ্ঠানিক কাজ। কৌতূহলি বাচ্চাদের সবাইকে একত্রিত করে ছবি তুলে আবার তা দেখালেন বাচ্চাদের। সবাই এখানে ওখানে নানা দৃশ্যের সবগুলোর ছবি তুলতে তুলতে আরো করলেন দশ মিনিট।





তারপর বিদেয় এবং রওয়ানা হওয়ার পালা। সবাইকে হাত নাড়িয়ে বিদেয় দিয়ে কিছুদূর আসার পর, আহমাদের সখ জাগল আরও কিছু দৃশ্যায়ন করবে। ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে বের হয়ে জানালেন, কিছুক্ষন পর গিয়ে গাড়িতে উঠবেন। চলে গেল আরও দশ মিনিট।

তারপর অবশেষে দারুন এক অভিজ্ঞতার সফরকে বিদায় জানিয়ে রওয়ানা দিলাম চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। পথে জানতে পারলাম-এই যে এতকিছুর ছবি তোলা হল সারা দিন মিলে, সব মিলিয়ে নাকি রিপোর্টটি হবে মোট দু'মিনিটের!! সামনের সপ্তাহান্তে প্রচারিত হওয়ার কথা-ইমেইলে অথবা এসএমএস করে জানাবে বলল।

ফিরার পথটা মনে হল অনেক তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল! অফিসে যখন আমাদের ওরা পৌছে দিল, তখন বিকেল পাচটা। দারূন এক অভিজ্ঞতা নিয়ে শেষ করলাম আরেকটি কর্মময় দিন।

........................................................................................................................

বাংলাদেশের দুইটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিতে ৩ মাসের ইন্টার্নশিপ আর আড়াই মাসের চাকুরির সুবাদে বেশ অনেক ধরনের, অনেক দেশের, অনেক ঢংয়ের, অনেক রংয়ের মানু্ষের সাথে মিশার অভিজ্ঞতাই হয়ে গেল আমার-বাদ নেই এমনকি বর্তমান এবং সাবেক উপদেষ্টা এবং মন্ত্রীও।
কিন্তু আলজাযিরার টিমের সাত্থে কাটিয়ে দেয়া এই দিনের অর্ধেকটা যেন সব অভিজ্ঞতার উপরে আলাদা স্থান জুড়ে থাকবে অনেকদিন-অথবা সারা জীবন।

3 comments:

MASS XFR said...
This comment has been removed by the author.
Anonymous said...
This comment has been removed by the author.
যাযাবর said...

ছবিগুলা দেখছি! :) ছোট ছেলেগুলাকে ক্যামেরা দিয়ে খুব সম্ভব ওদের নিজেদের ছবি দেখানোর সময় ওদের মুখের হাসিটা কি মারাত্নক রকম খুশীর!