Friday, October 31, 2008

দু'দিনের ভিসা

[চাচার সাথে পরিচয়টা হয়েছে অফিশিয়াল কারনেই। উনি আমাদের অফিসের একটি কাজ করে দিয়েছিলেন গত জুলাইয়ে। কাজটা গোছানোর দায়িত্ব আবার দেয়া হয়ছিল আমার মত একেবারেই আনাড়ি পুচকাকে-তখনো কেবল এক মাস হলো আমি ঢুকেছি ঐ অফিসে। আমি তো উনার পরিচয় পেয়েই ভয়ে অস্থির। পরে সব ঠিকঠাক মতো হল, আর বোনাস হিসেবে এমন চমৎকার একজন মানুষের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয়টাও হয়ে গেল। উনি অবশ্য চাচা হয়ে উঠেছেন আরো পরে, যোগাযোগটা অব্যাহত ছিল বলেই।
ওনার ব্লগের এই পোস্টটা পড়ে ভীষন অবাক হয়েছিলাম, আমার নিজের শহরে এমন নৃশংস ঘটনা নিত্যদিন ঘটে যাচ্ছে জেনে। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম অনুবাদ করে আমার ব্লগে দিব। অনুমতিও মিলল চাইতেই। তবে ম্যালাদিন হয়ে গেল, লিখব লিখছি করে লিখা হয়ে উঠেনি।
আজ বহুদিন পর ভাবলাম, এখনই সময়। চুম্বক অংশটা মেইলে ছিল, ঐটাই অনুবাদ করেছি। বাকিটা পড়ে নেয়ার দায়িত্ব পাঠকের হাতে তুলে দিলাম।]
ওদের গানের সুর ভেসে আসে। হৃদয়ছোঁয়া সুরে সহজ-সরল জীবনের গান। সুরেলা গান আর নৃত্যের ছন্দময়তার সাথে পা ফেলে ওরা এগিয়ে যায়, গমনপথে মিথ্যে সৌন্দর্য্যের পদচ্ছ্বাপ ফেলে।বুঝতে দিতে চায়না কাধেঁর ওপর বয়ে চলা ধাতব পাতের ভর পৃথিবীসম।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বর্জ্য ধাতুর ওপর কাদার কারুকাজ। তার ওপর খালি পা ফেলে ফেলে যাওয়া; “বিপজ্জনক শব্দের এর চেয়ে ভাল উদাহরণ কমই হয়। তার ওপর যদি হয় বৃষ্টি, তবে তো কথাই নেই। একটু পিছলে পড়া মানে যে কত বড় ক্ষতির আশংকা, ভাবতেই গা শিউরে ঠে!
তবুও, সাবধানি পা ফেলে তাদের পথচলা থেমে নেই। থেমে নেই গান গাওয়াও- এ যেন মৃত্যুর গান, অবিরাম মৃত্যুর পথে হেটে চলার সংগ্রামের গান।

সে রাতে ম্যানেজার চলে গেলে, সুযোগ মিলল ইয়ার্ডে গিয়ে ওদের সাথে ঘুমানোর। আমরা ছিলাম অতিথি। তাই ভাগ্যে আমাদের একটা গোটা চাদরই জ়ুটেছিল-ধাতব চাদর; বিছানা হিসেবে আর কি চাই! ওরা গান শোনালো আমাদের। এই এফএম রেডিও, আর ক্লোজ-আপ ওয়ান অথবা সেরাকন্ঠ তারকার যুগে প্রায়শঃই শুনে থাকা ঐ সব মেটাল আর রক গান কিংবা আভিজাত্যের প্রতীক রবীন্দ্র সংগীত নয়। ওদের কন্ঠে শুধু বিরহ আর বিচ্ছেদের ভীতিকর সব গান।
একটি ছিল ভিসা নিয়েঃ
"দুই দিনের ভিসা নিয়া এ মিছা দুনিয়া
কেন পাঠাইল আল্লা
কেন পাঠাইল রে
দিয়ারে ও সুখ জ্বালা
পাঠাইলো একেলা
এ কেমন খেলা আল্লা
খেলাইল রে?"

......
সংবাদটা নূরজাহানের জন্য অসহনীয় পর্যায়ের ছিল। বড় ছেলেটা দুর্ঘটনায় মারা গেছে এক বছর হয়েছে মাত্র। দু’মাস আগে স্বামীটাও চলে গেলেন ওপারে। তার দু সপ্তাহ পর জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই আলমগীর অন্য একটা ইয়ার্ডে কাজ করতে গিয়ে আহত হয়েছিল। সেইবার ইয়ার্ডের মালিক চিকিৎসার খরচ দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সে আবার কবে কাজে ফেরত যেতে পারবে, আর কতোদিনই বা ওরা চিকিৎসাব্যয় বহন করবে, তা কে জানে ?
জাহাঙ্গীই ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এর বাইরে পড়শীদের একটু আধটু দাক্ষিণ্য ওপরও নির্ভর যে করতে হতোনা তা নয়জাহাঙ্গীরের আহত হওয়ার সংবাদটা তাই পুরো পরিবারকেই অকূলে ভাসিয়ে দিতে যথেষ্ঠ ছিল। “এই গরীব হওনের কারনেই আমার পোলাগো এই জীবনে পা দিতে হৈসে। আমার জাহাঙ্গী যদি বাইচা ফিরে আসে ওরে আমি আর ঐ ইয়ার্ডে পাঠাইতেসিনা”
......
জাহাঙ্গী আর "বাইচা" ফিরে আসেনি। একটু অস্ফুটে কথা বলেছিল একদিন, মনে হয়েছিল ফিরে আসবে। কিন্তু সেই-ই শেষ। পরের দিন সকালেই জাহাঙ্গী নিষ্ঠুর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে গেল। এই দুর্মূল্যের বাজারে চিকিৎসাদির একগাদা বিল বাঁচাতে হয়তো এইটাই দরকার ছিল।
যাক, একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল। জাহাংগীরের দু’দিনের ভিসা এখানেই শেষ।

চট্টগ্রামের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে একটি জাহাজ ভাঙতে গিয়ে আরো এক শ্রমিকের মৃত্যু হল
এখানে বসে আমরাই জানতে পারিনা, আর অনেক দূরে-নিশীথ সূর্যের দেশ নরওয়েতে বসে সেই জাহাজের মালিকেরা কখনো জানবে কী,
জাহাঙ্গী নামের কেউ কখনো জন্মেছিল?
বিঃদ্রঃ অনুবাদে বিশেষ সহযোগিতার জন্য টক্স কে ধন্যবাদ।

3 comments:

যাযাবর said...

কথা খুঁজে পাচ্ছিনা। ......পৃথিবীকে আমার প্রায় সময়ই খুব অমানবিক জায়গা মনে হয়। ...... নিজে যদি জাহাংগীরের বোন হতাম, তাহলে কেমন লাগতো তাই ভাবছি গুম হয়ে বসে... ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির নাগরিকেরা থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির নাম না জানা কত মানুষের রক্ত আর অশ্রুর বিনিময়ে যে তাদের বিলাসী জীবন কাটায় - তা খোদাই বলতে পারবেন ঠিক করে।

~ মেঘের অনেক রং ~ said...

কম বয়সের অনেক ছেলেই ডক ইয়ার্ডে কাজ করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেই শ্রম ওরা দেয় সেই পরিমান ন্যায্য পাওনা এই লোক গুলো পায়না। আর তাদের কাজের পরিবেশের কথা...... তা নাহয় নাইবা বললাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল এই লেখাটি পড়ে। ধন্যবাদ এমন একটা বিষয় নিয়ে লেখার জন্য।

HJKL said...

কি বলবো ???? কিছুই বলার নেই। বলতে পারি শুধু এটুকুই, "এভাবেই গরীবের রক্ত চুষে নিবে ওরা আজীবন। আমাদের কিছুই করার নেই, করতে পারব কিনা ???? তাও জানিনা"