Friday, March 20, 2009

আমার পনেরো টাকা খেয়ে কি সে বড়লোক হবে?

গতকাল সন্ধ্যা। অফিস শেষে বাসায় ফিরছি। আমার বাসাটা একটু পাহাড়ি জায়গাতে হওয়ায় সাধারনতঃ এই সময়ে রিকশা পেতে একটু কষ্ট হয়। তবুও দু'একজন ফিরিয়ে দেয়ার পর এক মধ্যবয়েসী রিকশাওয়ালা রাজি হলো। ভাড়া একটু বেশি চাইলেও তাতেই চড়ে বসলাম।
সারাদিন কাজের চাপে কোনোদিকে তাকানোর সুযোগ হয়না। তাই এই রিকশা করে বাসায় ফেরার মুহূর্তটাকে একটু উপভোগ করার চেষ্টায় থাকি সবসময়। প্রতিদিনের মতো বিল্ডিং এর ভীড়ে আকাশটা হারিয়ে যাচ্ছে বলে দুঃখ করছিলাম আর সদ্য গড়ে ওঠা অসম্ভব সুন্দর সিডিএ মসজিদটির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এইখানে একদিন নামায পড়তে আসতে হবে।
এমন সময় রিকশাওয়ালা হঠাৎ বলে উঠলেন "আমার পনেরো টাকায় কি সে বড়লোক হবে?"



ভাবনায় ছেদ পড়ল আমার। কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম, "চাচা, কি হৈসে?"
"আপনি এখন যেখানে যাচ্ছেন, সেখান থেকেই এক স্টুডেন্ট কে নিয়ে আসছিলাম একটু আগে, মেডিকেল হোস্টেল থেকে..." রিকশাওয়ালার শুদ্ধ উচ্চারণ শুনে স্তম্ভিত হয়ে আমি কান পেতে রই। রাস্তার শত শত রিকশা, গাড়ি, ট্যাক্সির ক্রিং ক্রিং আর ভেঁপুর শব্দে অন্য সময় কানে হাত দিয়ে বন্ধ করে থাকা আমার কানে যেন আর কোনো শব্দই যাচ্ছিলনা। মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছিলাম অনেকক্ষন থেমে থেমে, অনেক দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কখনো বা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে যাওয়া কথাগুলোঃ
"...আমি ওঠার সময়ই জিজ্ঞেস করেছিলাম- 'আপনি কি গোলপাহাড়ের মোড়ে নামবেন, নাকি আরো সামনে যাবেন?' সে বলল, 'মোড়েই নামব'। তারপর গোলপাহাড়ের মোড়ে যখন আসলাম, সে বলে আরো সামনে যেতে। আমি বললাম যাবোনা। সাথে সাথে ছেলেটা নেমে হাঁটা দিল। আমি তাকিয়ে থেকে বললাম "'যাক, এই পনেরো টাকা আমি আল্লাহর নামে সদকা করে দিলাম'"
তাচ্ছিল্যের হাসিটা আমার চোখ এড়াল না।
বলে যাচ্ছিলেন তিনি, "আমি মনে করি মূর্খরাই অনেক ভালো। এরা অন্তত গরীবের টাকা মেরে খায়না। শিক্ষিত হয়ে যারা মূর্খের টাকা মেরে খেতে পারে তাদের শিক্ষার কোনো মূল্য আছে?"
নিজে "শিক্ষিত" হয়ে এক "মূর্খের" কাছে এমন কথা শুনতে হচ্ছিল বলে নিজেকে ধিক্কার দেয়া ছাড়া, নিজের শিক্ষার জন্য নিজের লজ্জিত হওয়া ছাড়া আর কীইবা করার আছে? শুনে যাচ্ছিলাম উনার চাপা ক্ষোভের উদ্‌গীরণঃ
"ছেলেটা দেখতে এতো সুন্দর! ফর্সা চেহারা, ইয়া লম্বা গড়ন, যা সুন্দর ফিগার! কিন্তু এত সুন্দর একটা মানুষের ভেতরটা এত পঁচা হয় কি করে?"
আমি তাকিয়ে থাকি লা-জবাব...
বিরতি দিয়ে দিয়ে, হাফ ছেড়ে ছেড়ে, মনের ভেতরে চেপে থাকা অনেক ক্ষোভ, অনেক রাগ ঝেড়ে ঝেড়ে তিনি বলেই চললেন...
"কিন্তু, আমার যদি সেই বয়স থাকত, আমার যদি সেই শরীর থাকত- ছাড়তাম না আমি, এতো সহজে তাকে ছাড়তাম না...
আমার পনের টাকা। আল্লাহ্ তো কোরানে লিখে দিয়েছে,আমার হক খেয়ে সে পার পাবে?"
বার্জার অফিসের উল্টোদিকের মসজিদটি পার হওয়ার সময় মাগরিবের আজান আসছিল ভেসে- একটু বিরতি দিলেন তিনি।
রিকশা তখন চট্টেশ্বরী রোডের ঢালু পথ দিয়ে নামা শুরু করল।
"এই পথ দিয়েই একটু আগে তাকে নিয়ে যাচ্ছিলাম। কি কষ্ট এই পথ বেয়ে ওঠা, চিন্তা করা যায়?" আবার দীর্ঘশ্বাস। "আমি দোয়া করি, বাবা, তোমাকে যেন আল্লাহ কোটিপতি করে। কোটি কোটি টাকার মালিক করে"
সেই তাচ্ছিল্যের হাসিটি আবার। তীরের মতন প্রাণভেদী শোনালো এবার...
গন্তব্যে পৌঁছে গেছি ততোক্ষনে। কোনোমতে সান্ত্বনার মত কিছু একটা বললাম, "চাচা, আপনি ভাববেন না, আল্লাহ হাশরের দিনে সেই পনের টাকার জন্য হলেও স্টুডেন্ট টাকে আটকে রাখবে। আপনি সেদিন অন্ততঃ আল্লাহর কাছে বিচার পাবেন"।
"মূর্খ" লোকটির দিকে "শিক্ষিত" আমার তাকানোরও যেন সাহস নেই। নিচের দিকে তাকিয়ে কোনরকম ভাড়াটা মিটিয়ে চলে এলাম...।
একবার মনে হয়েছিল, আমার কাছ থেকে পনেরো টাকা দিয়ে দেই, কিন্তু তখন আবার মনে পড়ল তার দৃঢ় ব্যক্তিত্বপূর্ণ উচ্চারণ "সেই পনেরো টাকা আমি আল্লাহর রাস্তায় সদকা করে দিলাম"। নাহ, সেই ব্যক্তিত্বের কাছে আমি আর আমার পনেরো টাকা অনেক অনেক ক্ষুদ্র...।
তার চাইতে আমার বোধহয় উনার কাছে পা ধরে মাফ চাইলেই ভালো হতো। আমাদের "শিক্ষিত" সমাজের পক্ষ থেকে একজন "শিক্ষিত" হিসেবে এই "মূর্খ" লোকটার কাছে পায়ে ধরে মাফ চাইলেই হয়তো উনার ক্ষোভ কিছুটা কমতো!
কিন্তু, এসবের কিছুই না করে, আমি আমার অনেক আহত কিন্তু "শিক্ষিত" মন নিয়ে, "শিক্ষিত" শরীরটাকে বইয়ে আমার ঘরে ফিরে এসে আরো বেশি "শিক্ষিত" হতে মনোনিনেশ করি...।
কিন্তু মনের ভেতর কোথায় যেন একটা তীব্র‌ হাহাকার চিৎকার করে ওঠে...
এক "মূর্খ" রিকশাওয়ালা পনের টাকা সদকা করে দিয়ে এই "শিক্ষিত" সমাজের প্রতি যে ধিক্কার দিয়ে গেল, তা শোনার লজ্জা আমি কোথায় রাখি???

2 comments:

Anonymous said...

সব গরীব মাইরা ফেলাইলেই হলো,
কারো আর এতো কষ্ট লাগতো না।
-চিনির্মাণ

~ মেঘের অনেক রং ~ said...

Kichuiii bolte parchina... satyee kono kotha ashchena amar...
nijer shohoreiri ghotonato.... tai kemon jeno lagche. :(